লোকে বলে সমসকৃতো নাকি খুব শক্ত, কারণ সন্ধির মারপ্যাঁচে নাকি আস্ত আস্ত বাক্যকে মুনি-ঋষিরা একেকটা শব্দে নামিয়ে আনতেন। তবে আমি বলি কি, আমরা বাঙালিরাও খুব কম যাই না। ফুটপাথে ওই যে হকারটা আপনাকে প্রতিদিন অফিস-ফেরতা "কুড়ি টাকায় দু' জোড়া মোজা নিয়ে যান" বলে বিরক্ত করে তাকে আপনি কী বলে উত্তর দেন? "আমার দরকার নেই" ... তাই না? একটু ভেবে বলুন তো, ঠিক তাই কি বলেন? নাকি বলেন "আমাদ্দরকান্নেই"?
এই হচ্ছে সন্ধি। বাংলায় নানারকম সন্ধি হয়; তবে র্-এর উপর দিয়ে সন্ধির ঝাপটাটা যতখানি যায়, ততখানি বোধ করি আর কোনও ধ্বনির উপর দিয়ে যায় না, বিশেষ করে সেই র্ বেচারা যদি শব্দের শেষে আসে। শব্দের শেষের র্ সত্যিকারের র্-এর মত উচ্চারিত হয়, যদি তা বাক্যেরও শেষ হয়, অথবা পরের শব্দ স্বরধ্বনি দিয়ে শুরু হয়, তবেই। নচেত্, শব্দের শেষের র্-এর পরে একই বাক্যের পরবর্তী শব্দ যদি ক-বর্গ, প-বর্গ এবং হ ভিন্ন অন্য যেকোনও ব্যঞ্জনধ্বনি দিয়ে শুরু হয়, তবে আমাদের র-বাবুও তার নিজের স্বরূপ বদলে সেই ধ্বনির ভেক ধরে - ধ্বনিতত্ত্বের ভাষায় একে বলে "সমীভবন"। অবশ্য সেই ধ্বনি যদি মহাপ্রাণ হয় তবে, ভেকটা ঠিক পুরোপুরি ধরতে পারে না, কারণ বাংলায় পর পর দু'টি মহাপ্রাণ ধ্বনির উচ্চারণ বে-আইনি। সে-ক্ষেত্রে বেচারাকে সংশ্লিষ্ট লঘুপ্রাণ ধ্বনির বেশেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। সেই জন্যেই আমরা "আমার থেকে"-তে র-এর জায়গায় "ত্" (থ্-এর সংশ্লিষ্ট লঘুপ্রাণ ধ্বনি) উচ্চারণ করি, এবং "তোমার চেয়ে"-তে "চ্" উচ্চারণ করি। স্বভাবতঃ-ই পরের প্রশ্ন যেটা ওঠে সেটা হচ্ছে, র্-এর পরের ধ্বনি ক-বর্গ, প-বর্গ, বা হ হলে কী হয়। তখনও কিন্তু র্ নিজের স্বরূপ বজায় রাখতে পারে না; তবে সমীভবনও হয় না। তখন র্-এর উচ্চারণ অনেকখানি আলতো ভাবে হয়, এবং অনেক ক্ষেত্রেই (যেমন:- তাড়াহুড়ো করে কথা বলার সময়) একে বারেই লোপ পেয়ে যায়, তবে লোপ পেয়ে গেলে আগের স্বরধ্বনিটির উচ্চারণ দীর্ঘায়িত হয়। তাড়াহুড়োতে আমরা তাই প্রায়ই "আমার মনে হয়"-কে অনেকটা "আমাআ মনে হয়"-এর মতো উচ্চারণ করে থাকি। "আলতো ভাবে উচ্চারিত হয়" কথাটার অবশ্য ধ্বনিতত্ত্বে বিশেষ কোনও মানে হয় না। তাই, আরও নিখুঁতভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে, খাঁটি র্-এর উচ্চারণ হচ্ছে দন্তমূলীয় কম্পিত ধ্বনির (IPA: [r])। আলতো উচ্চারণের ক্ষেত্রে এই কম্পনের মাত্রাটা অনেকখানি কমে যায়। ঠিক কতখানি কমে সেটা আমি এই মুহূর্তে বলতে পারব না, তবে ধ্বনিতাত্ত্বিকরা যন্ত্র-পাতি দিয়ে সেটা সহজেই মেপে ফেলতে পারবেন ... এবং এতদিনে নিশ্চয়ই ফেলেছেনও, তবে তার ফলাফলটা আমার জানা নেই।
যদিও আমি মূলতঃ শব্দান্তস্থিত র্-এর কথা বলছি এতক্ষণ ধরে, এই সন্ধির নিয়মগুলো কিন্তু অনেক সময়ই শব্দের মাঝখানেও প্রযুক্ত হয়। যেমন ধরুন, "করছি"-র জায়গাতে আমরা অনেক সময়ই "কচ্ছি" বলে থাকি, তাই না? এবং সেই জন্যই, কেউ "খেতে পাচ্ছে না" বললে, অনেক সময় আমাদের সন্দেহ হয় ব্যক্তিটি অত্যন্ত গরিব হওয়ায় খাবার যোগাড় করতে পারছে না, নাকি দাঁতে ব্যথা বলে "খেতে পারছে না"!
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
দিব্য, অসাধারণ। বিশেষ করে খেতে পাচ্ছে না-র ব্যাপারটা। এমনি চলতে থাকলে বাংলা ভাষার অনেক ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে উঠবে। শৈলীও চমৎকার। আমার ব্লগে লিঙ্ক দিয়েছি। সাথে ব্লগ পড়বার জন্য ঢেঁড়াসই দিয়েছি।
ReplyDeleteউত্সাহ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। :) "ঢেঁড়াসই" কথাটা বেশ খেলেছে, কিন্তু।
ReplyDeleteআপনার ব্লগ পড়ে মুগ্ধ হলাম। বাংলা ভাষার সৌন্দর্য আমরা ভুলে থাকি। এটা ঠিক নয়। আপনার মতো করে গভীরভাবে কয়জনই বা ভাবতে পারে, তাই না?
ReplyDeleteaR
BanglaBlogTips
বুঝতে পারছি আপনার ব্লগটি আমাকে নিয়মিত পড়তে হবে।
ReplyDeleteআপনাদের উত্সাহবাণী শুনে বড়ই বাধিত হলাম।
ReplyDeleteবাপরে মাথা ঝিম্ ঝিম্ করছে । একটা ব্যাপার বুঝলাম না "র্" এর যায়গাতে সব যায়গাতে রেফ্ ( র্ ) লিখেছিস কেন ?
ReplyDeleteঅার লোকজনের এত উৎসাহবানণী বৃথা যাচ্ছে কেন? মানে পরের ইনস্টলমেণ্ট কই?